Saturday, December 28, 2013

নারীর শরীর



সংকলনে এম হাসান
বিদেশী পত্রিকা অবলম্বনে
যে নারী শরীর নিয়ে যুগে যুগে পুরুষেরা নানা জল্পনা-কল্পনা চালিয়ে এসেছেন, রহস্যে ঢাকা কুয়াশায় ঘেরা সেই শরীরের ভেতর আর বাহির নিয়ে আলোচনা এই নিবন্ধে।
শরীর যন্ত্রের ইতিকথন
একই অমৃতের সন্তান হলেও মানুষ আর মানুষীর মধ্যে থেকে যায় নানা স্তরে বিস্তর তফাৎ। সবচেয়ে বড় তফাৎ থাকে শরীরের কাঠামোতে। ভ্রূণ অবস্থা থেকেই একটু একটু করে আলাদা হয়ে যেতে থাকে নারী-পুরুষের শারীরিক গঠন।
গঠন ভেদ
মা হবার সচনা থেকে গর্ভাবস্থার আট সপ্তাহ পর্যন্ত পুত্র বা কন্যা ভ্রূণকে আলাদা করা যায় না। এক সপ্তাহ পরে যখন ভ্রূণটি লম্বায় মাত্র ৩ সেঃ মিঃ আর ওজনে মাত্র ২ গ্রাম তখনই বাইরের যোনিপথের ঝিল্লিগুলো অদৃশ্য হয়ে যায় কন্যা ভ্রূণের।

যোনিদ্বারের প্রারম্ভিক গড়ন তৈরি হয়। একইভাবে পুত্র ভ্রূণের লিঙ্গ দ্বারের একদিকের ভাঁজ বেড়ে যেতে শুরু করে। প্রাথমিক লিঙ্গের আদল নেয়। এগারো সপ্তাহের মধ্যেই যৌনাঙ্গের বাইরের গড়ন সম্পর্ণ হয়। এই পুরো প্রক্রিয়াটা অনেক বেশি জটিল ভ্রূণের ভেতরে। গঠন গত প্রভেদ তৈরি হবার আগে ভ্রূণের দু রকম টিউব থাকে। মুলারিয়ান ও উলফিয়ান। কন্যা ভ্রূণের ক্ষেত্রে সাত থেকে নয় সপ্তাহের মধ্যে উলফিয়ান টিউব প্রায় অদৃশ্য হয়ে যায়। অথচ নিচের মুলারিয়ান টিউব যোনির গড়ন আনে খুব ধীরে ধীরে, তারপর চৌত্রিশতম সপ্তাহ পর্যন্ত জননগ্রন্থি প্রাথমিকভাবে ডিম্বাশয়ে পরিণত হতে থাকে। আর উপরের মুলারিয়ান টিউবটি হয়ে যায় ফ্যালোপিয়ান টিউব। পুরুষ ভ্রূণের ক্ষেত্রে ঠিক উল্টোটা হয়। মুলারিয়ান টিউব অদৃশ্য হয়ে গিয়ে জননগ্রন্থিগুলো জড়ো হয়ে তৈরি করে অন্ডকোষ।
রজঃদর্শন বা বয়ঃসন্ধি
বয়ঃসন্ধি বা রজঃদর্শনের সময়ে নারী বা পুরুষের মধ্যে জনন ক্ষমতা তৈরি হয়। কিশোরী হয়ে ওঠে নারী। যে নারী যৌনক্রীড়ায় সঙ্গিনী হয়, আবার মা-ও হতে পারে। এ সময় মেয়েদের ডিম্বাশয় পরিপক্বতা পায়। শুধু তাই নয়, বয়ঃসন্ধির সবচেয়ে বড় লক্ষণ রজঃস্বলা হওয়ারও সূচনা এই সময়ে হতে থাকে।

কিন্তু এই দুটি পরিবর্তনই একমাত্র বয়ঃসন্ধির লক্ষণ নয়। সারা শরীর জুড়েই তখন পরিবর্তনের ঢল নামে। শরীরের এই হঠাৎ বদলে যাওয়া ছাপ ফেলে বয়ঃসন্ধির কিশোরী মনে ও চেতনায়। এর ফলে তার বালিকা স্বভাব ধীরে ধীরে কমে আসতে থাকে, তার জায়গা নিতে থাকে স্ফুটনোন্মুখ নারীত্ব।
সূচনা সময়
এটা সব মেয়ের জীবনেই গুরুত্বপুর্ণ। যদিও নানা কারণে সময়ের হেরফের হতেই পারে। যেমন বংশগত কারণে, পুষ্টিগত কারণে, মানসিক বা শারীরিক অন্যান্য কারণেও ঋতু শুরু হবার সময়টা অনেক পিছিয়ে যেতে পারে। শৈশবে দীর্ঘ রোগ ভোগ বা মানসিক জোরালো আঘাত কাটিয়ে ওঠার ফল হিসেবেও অনেকের ক্ষেত্রে এর সূত্রপাত হতে পারে নির্দিষ্ট সময়ের পরে।
হরমোন প্রক্রিয়া
বয়ঃসন্ধি একটি কিশোরীর শরীরে যেসব বদলগুলো এনে দেয় তার প্রধান সূত্র লুকিয়ে থাকে মস্তিষ্কের একটি বিশেষ প্রদেশে। তার নাম হাইপোথ্যালামাস। ঋতুর সূত্রপাতের বছর দুই আগে থেকেই হাইপোথ্যালামাসের ক্ষরণ শুরু হয়। একে বলেরিলিজিং ফ্যাক্টটরসএই ক্ষরণ পিটুইটারি গস্ন্যান্ডে পৌঁছে রাসায়নিক উপাদান তৈরি করে। এরই নাম হরমোন।
প্রথম যে হরমোন তৈরি হয় সেটাকে বলা হয় ফলিকল স্টিমিউলেটিং হরমোন, সংক্ষেপে এফএসএইচ। এটার প্রভাবেই অন্য ফলিকল ইস্ট্রোজেন তৈরি করে। এই ইস্ট্রোজেনই বুক ও জননেন্দ্রিয়ের গঠনে সাহায্য করে।
হাইপোথ্যালামাস আর একটি যে উপাদান তৈরি করে তার নাম লিউটেনাইজিং হরমোন। এই হরমোনটি একটি ফলিকলকে ফাটিয়ে তার ডিম্বাণুকে বেরোতে সাহায্য করে। এই ডিম্বাণুটির সম্ভাবনা থাকে উর্বর হয়ে ওঠার বাকি মৃত ফলিকলগুলোকে বলা হয়করপাস লিউটিয়াম
এগুলো ইস্ট্রোজেন ক্ষরণকে চালু রাখে এবং নতুন ক্ষরণও তৈরি করে। তার নাম প্রজেস্টেরন। এই প্রজেষ্টেরন আবার ইউটেরাসের মধ্যে একটা আস্তরণ প্রস্তুত করে উর্বর ডিম্বাণুটিকে গ্রহণ এবং লালন করার জন্য। ডিম্বাণুটির যদি উর্বরতা না থাকে তাহলে রক্তে ইস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টেরনের মাত্রা কমে যায়। তার ফলে জরায়ুর ভেতরের আস্তরণটি ছিড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে যে রক্তস্রাব শুরু হয় সেটাই হলো প্রথম ঋতুস্রাব। এই ঋতু বা রজঃস্রাব বয়ঃসন্ধি থেকে নিয়মিতভাবে হতে থাকে ২৮দিন অন্তর, যতদিন না রজঃনিবৃত্তি হয়।
বয়ঃসন্ধি ও শারীরিক ক্রমবিকাশ
মেয়েদের বয়ঃসন্ধি আসে নয় থেকে চৌদ্দ বছরের মধ্যেই। আর থাকে চৌদ্দ থেকে আঠারো বছর পর্যন্ত। কিন্তু এই বয়ঃসন্ধির প্রভাবে যে পরিবর্তনগুলো আসে তার সূত্রপাত এগোরো থেকেই বদলের প্রক্রিয়াটি চলতে থাকে চৌদ্দ পর্যন্ত। সকলের ক্ষেত্রেই সবরকম পরিবর্তন আসে, তা নয়, কিন্তু এর মধ্যে কয়েকটি গড়ে প্রায় সব মেয়েরই হয়।
আগে ও পরে
বয়ঃসন্ধির আগে পর্যন্ত স্তন থাকে অপরিপুষ্ট। বাহুসন্ধি বা জননেন্দ্রিয়ের কাছে লোমের চিহ্ন থাকে না। দেহের গড়ন থাকে একটি বালকের মতো। ঋতু দর্শন যখন তাড়াতাড়ি হয় এগারো থেকে তেরোর মধ্যে তখন মুখ অনেকটা ভরাট হয়ে ওঠে। শ্রোণী বা তলপেট পরিপুষ্ট হতে থাকে সন্তান ধারণের উপযুক্ত হয়ে ওঠবার জন্য। নিতম্বে মেদ জমতে শুরু করে। স্তন পুষ্ট হয়ে উঠতে থাকে স্তনবৃন্তও।
জননেন্দ্রিয়ের ভেতর ও বাইরের গড়ন সম্পর্ণ হতে থাকে, তার চারপাশে লোমের উন্মেষ হয়। যোনিপথের ভেতরের আস্তরণ মোটা হয়ে ওঠে।
ঋতুস্রাব দেরি করে যখন হয়, চৌদ্দ থেকে ষোলোর মধ্যে স্তন বড় হতে থাকে। ঘন লোমের উন্মেষ হয়, বাহু সন্ধি ও যোনিদ্বারের চারপাশেও ঋতুস্রাব শুরু হয়।
পরিপূর্ণতা (সতেরো থেকে আঠারো)
শরীরের রেখায় রেখায় এই বয়সে আসে পরিপূর্ণতা। কাঠামো বা হাড়ের বৃদ্ধি থেমে যায়। পরিপুষ্ট হয়ে ওঠে জননেন্দ্রিয়। ঋতু আবর্তন নিয়মিত হয়ে উঠতে থাকে আরও বেশি।
একই সময়ে শরীরের অন্যান্য তন্তুগুলোও বেড়ে উঠতে থাকে। গলা সামান্য ভারী হয়; রক্তচাপ, রক্তে লোহিতকণিকা বাড়তে থাকে। হৃদস্পন্দন ধীরে হয়। শরীরের তাপ কমে। নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস ধীরে হতে থাকে, কিন্তু ফুসফুসের ক্ষমতা বাড়ে। হাড় আরও শক্ত হয়ে ওঠে।
আঠারোর মধ্যেই একটি কিশোরী দৈর্ঘ্য প্রস্থে বেড়ে একজন পরিপূর্ণ নারীতে পরিণত হয়।
সমস্যার কথা
হরমোনের কমবেশির দরুন কিছু কিছু ক্ষেত্রে বয়ঃসন্ধির লক্ষণগুলো পরিস্ফুটই হয় না। তবে বেশিরভাগ যে সমস্যা মেয়েদের ক্ষেত্রে দেখা দেয় বয়ঃসন্ধির সময়ে সেটা মানসিক। কারও ব্রণ উঠতে শুরু করে, কারও ব্লাকহেডস দেখা দেয়। কেউ অতিরিক্ত মোটা হয়ে যায়-এবং এই সবকিছুই মনের ওপর ছাপ ফেলে।
বয়ঃসন্ধিতে কিশোরী অনেক সময় একটু উদ্ধত বা মেজাজি হয়ে উঠতে পারে। হয়ে উঠতে পারে অবাধ্য বা আলসেও। এর কারণ যেমন লুকিয়ে থাকে মানসিকতায়, তেমনি শারীরিক কারণেও এসব ঘটতে পারে। তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বয়ঃসন্ধির এইসব সমস্যা ক্রমশ কমে আসে। পরিপূর্ণ সেই নারী শরীরের যে কোনো সমস্যাই তখন নারীর সমস্যা, বয়ঃসন্ধি কিশোরীর বিপদ বা জটিলতা নয়।
মেনোপজ বা রজঃনিবৃত্তি
প্রাণীদেহের নিয়ম মেনেই একটা সময়ে মা হওয়ার বয়স ফুরিয়ে যায়। অবশ্য তাতে কোনো নারীর গরিমা ক্ষুণ্ন হয় না, কেননা ইতিমধ্যে সে একজন সন্তানবতী নারী হয়ে ওঠার সময় পার করে এসেছে। তবু প্রজনন ক্ষমতা শেষ হয়ে যাওয়া অবশ্যই একটি নারীর জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এর বাহ্যিক লক্ষণটি হল নিয়মিত ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে যাওয়া। তবে এর ফলে হরমোনের বৈষম্যের দরুন অন্য কিছু কিছু উপসর্গও দেখা দেয়। যেমন কারও কারও শরীরের কোনো কোনো অংশে বার্ধক্যের ছাপ প্রকট হয়ে ওঠে। এই সময়টায় মেয়েরা কখনও কখনও খুব বিমর্ষ হয়ে পড়েন। কেউ বা শারীরিক একটা ঝঞ্ঝাট এড়ানো গেল ভেবে খুশিও হয়ে ওঠেন।
সূত্রপাত
এক একজনের ক্ষেত্রে রজঃনিবৃত্তির সূত্রপাত হয় এক এক বয়সে। সাধারণত বয়সটা হল পঞ্চাশ। যদিও কিছু ক্ষেত্রে ত্রিশ বছর বয়সেই এটা হতে পারে। তবে অধিকাংশেরই পঞ্চাশ বছরে প্রজনন ক্ষমতা চলে যায়। খুব অল্প সংখ্যক মহিলাই পঞ্চান্ন পর্যন্ত প্রজননক্ষম থাকেন।
অস্ত্রোপচারের পরে রজনিবৃত্তি
কখনও অস্ত্রোপচারের ফলে মেয়েদের ডিম্বাশয় কেটে বাদ দিতে হয়। তখন যে রজঃনিবৃত্তির সচনা হয় সেটাকেই সার্জিক্যাল মেনোপজ বলে। এর ফলে ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে যায়, শেষ হয়ে যায় প্রজনন ক্ষমতা। ডিম্বাশয় থেকে জন্মানো হরমোনের প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। সেই জন্য এ সময় চিকিৎসকরা অনেকক্ষেত্রে ইস্ট্রোজেন দেন রোগীকে, যাতে এই আচমকা হরমোন ঘাটতি তিনি সামলে উঠতে পারেন।
মেনোপজের উপসর্গ
প্রথম যে উপসর্গটি এসব ক্ষেত্রে দেখা যায়, সেটা হল ঋতুস্রাবের অনিয়মিতা। তাছাড়া এ সময় ঋতুস্রাব কম হতে থাকে, দেরিতে হতে থাকে। কখনও এক দুমাস নাও হতে পারে। কখনও আবার এক মাসে খুব বেশি স্রাব, পরের মাসে খুব কম এমনও হতে পারে। এরই কয়েকমাস বা বছর পরে ধীরে ধীরে ঋতুস্রাব একেবারে বন্ধই হয়ে যায়। কারও আবার একেবারে আচমকা বন্ধ হয়ে যায়। শেষ ঋতুস্রাবের পর ঠিক এক বছর গেলে তবেই একজন পঞ্চাশোধর্ক্ষ নারীকে জননক্ষমতাশন্য বলা যেতে পারে।
তবে এসব ক্ষেত্রে গর্ভধারণ সম্পর্কে নিরাপদ হবার জন্য এর পরের বছর দুয়েক জন্মনিরোধক ব্যবস্থা নেয়া উচিত। বিশেষত পঞ্চাশের নিচে বয়স হলে এ ব্যবস্থা অত্যাবশ্যক।
রজঃনিবৃত্তি ও সমস্যা
অনেক মহিলার ক্ষেত্রে ঋতু বন্ধ হওয়াই মেনোপজের একমাত্র লক্ষণ। অনেকের অন্যান্য সমস্যাও দেখা দেয়। শরীরের ইস্ট্রোজেন কমে গেলে হাইপোথ্যালামাস গ্রন্থ্থির ক্ষরণে যে বদল দেখা দেয় তার ফলে এসব সমস্যা দেখা দিতে থাকে। মাঝে মাঝে মনে হতে পারে বুকের মধ্যে গরম ভাব, ক্রমশ গলা ও মুখের দিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে। এটা সারা শরীরেও ছড়িয়ে পড়তে পারে জ্বলুনি হয়ে। ঘামও হতে পারে সঙ্গে। মুখে গরম হাল্কা ভাব মিনিট পনেরো থাকতে পারে এবং দিনে কয়েকবার হতে পারে। আবার অল্পস্থায়ী হয়ে বারবারও হতে পারে। ঋতুর সময়ে এটা হতে পারে। আবার ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে যাবার আগে থেকে থামবার পরও বছর দুতিন পর্যন্ত এই উপসর্গ থাকতে পারে। এই উপসর্গের খুব বেশি বাড়াবাড়ি হলে বিমর্ষতা, রাতে ঘাম হয়ে ঘুম ভেঙ্গে যাওয়া ইত্যাদিও হতে পারে। চিকিৎসকেরা এসব ক্ষেত্রে ইস্ট্রোজেন বা ক্লমিফেন ওষুধ দিয়ে থাকেন।
হরমোনের পরিবর্তন শরীরের যে কোনো জায়গায় চুলকানি বা জ্বলুনির সচনা করতে পারে বিশেষত যোনিদেশে। তাছাড়া যোনিপথ রুক্ষ খসখসে হয়ে ওঠে। মলম ইত্যাদি তখন দেয়া হয়ে থাকে।
উলেস্নখিত উপসর্গগুলো ছাড়াও অনেক সময় মাথা ঝিমঝিম করা, মাথাব্যথা এবং অনিদ্রা ইত্যাদিও দেখা দিতে পারে। এ সময় অনেকেই বেশি অবসন্ন হয়ে পড়তে পারে, অনুভব করতে পারে উদ্যমের অভাব। কারও আবার হজমের গন্ডগোল, পেটে ব্যথা, ফোলা, অজীর্ণ ইত্যাদি পেটের গোলমাও দেখা দিতে পারে। অনেক সময় দম বন্ধ হয়ে আসা বা বুক ধড়ফড়ানিও হয়ে থাকে। তবে এসব উপসর্গ বা সমস্যা যে সবার ক্ষেত্রেই হবে এমন কথা নেই। প্রকৃতপক্ষে এমন কোনো উপসর্গের কথা হলফ করে বলা যাবে না যা সরাসরি রজঃনিবৃত্তির কারণেই হয়ে থাকে। তবে এরই জন্য পরোক্ষভাবে এসব হয় অনেকেরই।
কারও আবার রজঃনিবৃত্তির সময়ে খিদে বেড়ে যেতে পারে। অথচ এনার্জি কমে আসছে এমনও হতে পারে। ফলে প্রচন্ড মোটা হয়ে যাওয়াটাই অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। এ সময়ে খাওয়া কমানো উচিত। শুধু শারীরিক নয় এ সময়ে কিছু মানসিক উপসর্গও দেখা দেয়। খাম খেয়ালিপনা, চট করে রেগে যাওয়া, ভুলে যাওয়া, বেশি উৎকণ্ঠা, বিমর্ষতা ইত্যাদি অনেকেরই হয়ে থাকে। এর কারণ হিসেবে সরাসরি কোনো কিছুতে চিহ্নিত না করলেও বলা যায়, হরমোনের পরিবর্তনের জন্য যে মুখে বা শরীরের জ্বলুনি, মাথাধরা, অনিদ্রা ইত্যাদি দেখা দেয় তার ফলেই এসব মানসিক উপসর্গগুলো দেখা দিতে পারে। তাছাড়া বয়স হয়ে যাওয়ার ভয় অথবা যৌনজীবনে বিরাট পরিবর্তন আসতে চলেছে এমন উৎকণ্ঠাও এসব মানসিক উপসর্গের কারণ হতে পারে। অনেকেই কষ্ট পেতে থাকেন এই ভেবে যে, তিনি আর মা হতে পারবেন না।
রজঃনিবৃত্তি ও যৌনজীবন
অনেক মহিলাই এ সময় একটাই ভয় পান হয়তো এর ফলে তিনি নিজের আকর্ষণীয়তা হারিয়ে ফেলবেন। এরপর তিনি আর মা হতে পারবেন না। তার ফলে অনেকের ধারণা হতে থাকে তিনি হয়তো নারীত্ব হারিয়ে ফেললেন। তবে রজঃনিবৃত্তির সময় বা পরে কোনো সময়ে নারী-পুরুষের শারীরিক আদানপ্রদান বন্ধ রাখাটা প্রয়োজনীয় নয়। যদিও মেয়েদের এ সময়ে শারীরিক চাহিদাটা কমে আসে। কিন্তু এরপরে যৌন ক্ষমতা চলেও যায় না, সৌন্দর্যও নষ্ট হয়ে যায় না কোনো মতেই। আবার এরপরে যৌনমিলনে লিপ্ত হওয়ার মধ্যে অনৈতিক কিছুও নেই, এটাও মনে রাখতে হবে। তবে এ সময়ে অবাঞ্ছিত মাতৃত্বের ব্যাপারে সাবধান হওয়ার জন্য বা যোনিদেশের শুষকতার ব্যাপারে কি করা দরকার সে বিষয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে পারেন।
রজঃনিবৃত্তির পরের পরিবর্তন
ইস্ট্রোজেন মেয়েদের স্তন, জরায়ু, যোনিদেশ, পেশির মসৃণতা ও ত্বকের পুষ্টি বৃদ্ধি করে। শুধু তাই নয় আরও নানা রোগ ও ক্যালসিয়ামের ক্ষয়রোধ করে ইস্ট্রোজেন।
তাই ইস্ট্রোজনের ঘাটতি, রজঃনিবৃত্তির সময়ে শরীরে বার্ধক্যের চিহ্ন ফুটিয়ে তোলে। ইস্ট্রোজেনের ঘাটতির কারণেই পেশির টানটান ভাব চলে যায় এবং চামড়া ঝুলে পড়তে থাকে বয়সের রেখা দেখা যায়। একই কারণে স্তন বড় হয়ে ঝুলে পড়তে থাকে। জরায়ু ও ডিম্বাশয় ছোট হয়ে যায়। যোনিপথের দেয়াল পুরু হয়ে যায়। শুষকতা আসে যোনিদেশে, যখন তখন রোগ সংক্রমণের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তোলে। এই জন্য যৌনমিলন কখনও কখনও কষ্টকর হয়ে ওঠে।
এছাড়া যোনিদেশের লোম কমে যায়। ওপরের ঠোঁট ও চিবুকে লোম গজাতে পারে। এ সময়ে হৃদরোগের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। স্থূলতা বাড়ে বলে অনেক সময় বাতও দেখা দিতে পারে।
রজঃনিবৃত্তির অনেকদিন পরে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি মেরুদন্ড বাঁকিয়ে দিতে পারে।
ত্বক
অঙ্গ হিসেবে যদি ধরা যায় তবে ত্বক হল শরীরের বৃহত্তম অঙ্গ। প্রায় সতেরো বর্গফুট জায়গা ঢেকে রাখে ত্বক যে কোনো গড় মহিলার। আবার মোট ওজনের ষোলো শতাংশ এর ওজন। সারা শরীরে প্রায় ১.২ মিলি মিটার পুরু হয় ত্বক। ত্বকের ভেতরে থাকে তন্তু্তু যার জন্য ত্বক পায় নমনীয়তা। বিভিন্ন দেহ সন্ধির সক্রিয়তা বজায় থাকে এরই জন্য।
ত্বক হল শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এর দুটি পৃথক স্তর আছে। একটি এপিডারমিস, অন্যটি ডারমিস। প্রথমটি থাকে বহির্ভাগে, অন্যটি নিচের দিকে। এপিডারমিস স্তরটিকে ঢেকে রাখে কেরোটিন নামের একটি পুরু স্তর। তারই আর একটু জমাট চেহারা দেখি। ডারমিসের গভীরে পুরু স্তরের ঠিক ওপরে ঘাম নিষকাশন গ্রন্থ্থিগুলো থাকে যা থেকে বিভিন্ন নালী ও লোমকূপ দিয়ে ঘাম নিঃসৃত হয় ত্বকে। ডারমিসেই স্নায়ুগুলো থাকে আর থাকে রক্তবাহী নালীগুলো যা এপিডারমাল কোষকে পুষ্টি দেয়। এই এপিডারমাল সেলই চুল গজাতে সাহায্য করে।
ঘাম
ঘাম নিঃসরণের গ্রন্থিগুলো থেকে যে ক্ষরণ নিঃসৃত হয় তাকেই বলে ঘাম। ঘামের ৯৯% হল জল, এছাড়াও আছে নুন, ইউরিয়া এবং অন্যান্য বর্জ্য পদার্থ।
দেহগন্ধ
একজনকে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী তখনই বলা যায় যখন তার ঘাম থেকে সামান্য গন্ধ বের হয়। ত্বকে যে ব্যাকটেরিয়া থাকে সেটাই ঘামের সঙ্গে মিশে দুর্গন্ধের সৃষ্টি করে। যোনিদেশ বা বাহুসন্ধিতে যেহেতু ঘাম জমে থাকে সেহেতু ব্যাকটেরিয়াকে আকর্ষণ করে। শরীরের গড়ন ও জামা কাপড়ে ঢাকা থাকার কারণেই এসব জায়গা থেকে ঘাম চট করে শুকোয় না, ফলে গন্ধ তৈরি করে। পায়েও ঠিক একই কারণে ঘামের গন্ধ হয়।
ত্বক ও রোদ
রোদের অতি বেগুনি রশ্মির সংসপর্শে বেশি এলে ত্বকে মেলানিনের ঘনত্ব বেড়ে যায়। ফর্সা লোকদের ক্ষেত্রে এই লোনিন বেড়ে যাওয়াটা বাদামি ছোপ ধরায় বা মেচতার দাগ তৈরি করে।
স্তন
পূর্ণ বয়স্ক নারীর স্তন আসলে ম্যামারি নামক একটি গস্ন্যন্ড যাতে নরম এবং নিরবলম্ব মাংসপেশি থাকে প্রায় পনেরো থেকে পঁচিশটি। এগুলো তন্তু্তু দিয়ে আলাদা করা থাকে অনেকটা কমলা লেবুর কোয়ার মতো। প্রত্যেকটি মাংসপেশি মেদ দিয়ে ঢাকা থাকে।
শিশুর জন্মের পরে এই প্রতিটি মাংসপেশি যদি হয় এক একটি বৃক্ষ তবে সেই বৃক্ষের প্রতিটি পাতায় ছোট ছোট নালী বেয়ে প্রধান দুই নিঃসরণ নালী থেকে দুধ আসে। প্রধান নালীটি সে সময় স্ফীত হয়ে এরিওলার ঠিক নিচে একটি বড় আধার তৈরি করে। এরিওলা হল বোঁটার চার পাশের গাঢ় রঙের বৃত্তটি। ছোট ছোট নালীগুলোর সরু মুখ এই আধারের সঙ্গে বৃন্তের যোগ তৈরি করে। ফলে প্রতিটি মাংস পেশির সঙ্গে বোঁটার যোগ হয়ে ওঠে সরাসরি।
স্তনের আকার ও আয়তনের পরিবর্তন
নারীর জীবনের বিভিন্ন পরিবর্তনের প্রভাব আসে স্তনের আকার ও আয়তনের ওপর। বয়ঃসন্ধির আগে শুধুমাত্র গোলাপি বৃত্ত থাকে বোটাটিকে ঘিরে। বয়ঃসন্ধিতে এলে ১১ বছর বয়সে এরিওলা সামান্য ফুলে ওঠে বোঁটাও। হরমোনের ইস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টেরন ক্ষরণ স্তনের বৃদ্ধি ঘটায়। দুধ নিঃসরণের নালীগুলো বোঁটার ভেতরে বিকশিত হতে থাকে তাদের ঘিরে মেদ জমে। ফলে ষোলো বছর বা তারপরে স্তন পরিপুষ্ট হয়ে ওঠে।
গর্ভাবস্থায় এরিওলায় ফাটা ফাটা দাগ হতে পারে, স্তন অনেক নরম হয়ে যায়, শিরাগুলো খুব বেশি পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। গর্ভাবস্থার শেষের দিকে স্তন স্বাভাবিকের চেয়ে ১/৩ ভাগ বেশি বড় হয়ে ওঠে। বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানোর মেয়াদ শেষ হলেই স্তন আবার পূর্বাবস্থায় ফিরে আসে।
রজঃনিবৃত্তির সময়ে স্তন ঝুলে যেতে থাকে, ততটা উন্নত থাকে না।
চুল
শরীরের নানা অংশেই থাকে চুল। তিন ধরনের চুল থাকে। মাথার চুল, শরীরের চুল এবং যৌনাঙ্গের চুল। প্রত্যেকটি চুলই জন্মায় তার নিজস্ব পৃথক ফলিকল থেকে। প্রতিটি ফলিকলেই থাকে নিজস্ব তেলের গ্রন্থি ও ক্ষুদ্র পেশি। ছোট ছোট ধমনীগুলো রক্তস্রোত থেকে পুষ্টি পাঠায় এখানে।
চুলের প্রধান কাজ দুটি। এটা খানিকটা আঘাত ঠেকায়, খানিকটা গরম রাখে বিভিন্ন প্রত্যঙ্গকে। যেমন চোখের পাতাল চুলগুলো চোখকে আড়াল করে থাকে ও কানের চুলগুলো বাইরের যে কোনো পদার্থের ধাক্কা থেকে বাঁচায়। কপাল থেকে গড়িয়ে পড়া ঘামের ফোঁটা চোখে ঢুকে যাওয়া বাঁচায় ভুরুর চুলগুলো। শরীরের চুল বা লোম থাকায় হাওয়া ঢুকে চট করে বেরোতে পারে না, ফলে চামড়া ঠান্ডা হয় ও শরীরের তাপ কমে। এই লোমের প্রতিটির ফলিকলের সঙ্গে লেগে থাকা ছোট মাংসপেশির সংকোচন হয় ঠান্ডায় বা ভয়ে। ফলে লোম খাড়া হয়ে দাঁড়ায়।
গঠন ও গড়ন
মেয়েদের শরীরের গড়ন কেমন হওয়া উচিত? কোথায় কতটা মেদ থাকা দরকার, কেমন করে কোন খাবার খাওয়া স্বাস্থ্যকর, সঠিক ওজন এবং গঠনটাই বা কি? এবার এ প্রসঙ্গে-
শরীরের গঠন
৩৬-২৪-৩৬ মেয়েদের শরীরের এই মাপ আজ প্রায় কিংবদন্তি পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। কিন্তু সবার তো আর এই মাপ হয় না, হওয়া সম্ভবও নয়। প্রথমে জানতে হবে আপনার শরীরটা আসলে কোন ধরনের। সাধারণ শরীরের গঠন তিন ধরনের হয়-এক্টোমরফিক, মেসোমরফিক এবং এন্ডোমরফিক।
এক্টোমরফিক
লম্বাটে, রোগাটে এবং মেদহীন চেহারাকে এক্টোমরফিক বলে। এদের প্রায়ই গ্রেহাউন্ড কুকুর এবং রেসের ঘোড়ার সঙ্গে তুলনা করা হয়। এই শ্রেণীভুক্ত মানুষরা কিন্তু্তু যথেষ্ট খাওয়া দাওয়া করলেও সাধারণত ওজনে বাড়ে না। লম্বা দৌড়ে, উঁচুতে লাফ বা দরপালস্নার খেলাধুলাতে এরা ওস্তাদ হন।
মেসোমরফিক
গঠনগতভাবে এরা মজবুত শরীরের অধিকারী। কোনো বিশেষ জায়গায় এদের মেদ জমে না বরং এদের কাঁধ চওড়া ও সুগঠিত পেশি হয়।
আনুপাতিকভাবে এই শ্রেণীতে পুরুষের সংখ্যা বেশি। এই শ্রেণীভুক্ত মানুষের শারীরিক শক্তি এবং ক্ষমতা অন্যদের থেকে অনেক বেশি হয়।
এন্ডোমরফিক
এদের একটু বেঁটে, ছোট গঠন হয়। উরু, কোমর ও নিতম্ব একটু ভারীর দিকে হয় এবং সহেজেই মোটা হয়ে যাবার প্রবণতা দেখা যায়। বিশেষ করে শরীরের নির্দিষ্ট কিছু স্থানে মেদ জমে বেশি। সঠিক ট্রেনিং পেলে এরাও খেলাধুলায় পারদর্শী হতে পারে।
শরীরের ওজন
শরীরের স্বাভাবিক গড়নটা আমুল পরিবর্তন করা যায় না, কিন্তু সঠিক খাওয়া দাওয়ার অভ্যাস করে, নিয়মিত ব্যায়াম করে নিজেকে সচল রেখে শরীরকে সুগঠিত করা যায়। এক্ষেত্রে জানা দরকার কতটা উচ্চতা হলে কতটা ওজন সঠিক।

No comments:

Post a Comment